মুক্তাগাছার পূর্ব নাম ছিল বিনোদবাড়ি। ময়মনসিংহ জেলা থেকে দশ মাইল পশ্চিমে এর অবস্থান। প্রথম জমিদার রামরাম যখন বিনোদবাড়িতে আসেন, তখন স্থানটি ছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র দরিদ্র লোকের বাসস্থান। নতুন জমিদার উপস্থিত হলে তাকে দেখার জন্য সাধারন জনগন সাধ্যমত উপঢৌকন নিয়ে সম্ভাষন জানায়। এইসব উপহারের মাঝে মুক্তারাম কর্মকারের প্রদত্ত একটি গাছা (পিলসুজ) সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ছিল। রামরাম খুশি হয়ে মক্তারামের ‘মুক্তা’ আর তার ‘গাছা’র মিশিয়ে বিনোদবাড়ীর নাম দেন ‘মুক্তাগাছা’!
১৮৭৫ সালে মুক্তাগাছায় মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপিত হয়। পূর্বের আইন অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদাদিকার বলে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হতেন। পরে যখন চেয়ারম্যান র্নিবাচন চালু হয়, মহারাজা সূর্যকান্ত প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্দের পর হতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্দের পর পর্যন্ত এর আয়তন ক্রমশ বাড়তে থাকে। পাকিস্তান হবার পর হিন্দুরা চলে যেতে শুরু করলে, এর বৃদ্ধি বাঁধা প্রাপ্ত হয়। এরপর থেকে, মুক্তাগাছা মুসলমান অধ্যুষিত হয়ে গড়ে উঠে।
এখানে প্রথম থেকেই থানা, পোষ্ট অফিস, টেলিগ্রাফ অফিস স্থাপিত হয়। জমিদারদের আগমনের পূর্বে এখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল, যা ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দে জমিদার রামকিশোরের নামে ‘রাম কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়’ রূপান্তরিত হয়। জমিদারগন নিজেরাই এই বিদ্যালয়ের ব্যয়ের যোগান দিতেন। বড়হিস্যার মৃণালিনীদেবী তাঁর স্বামী নগেন্দ্রনারায়েণর নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটি পরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়, র্বতমানে এই বিদ্যালয়টি ‘নগেন্দ্র নারায়েণ ঊচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে।
মুক্তাগাছা মন্ডার জন্য বিখ্যাত । মন্ডা এক প্রকারের সন্দেশ, যা কেবল মাত্র ছানা ও চিনি দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। মুক্তাগাছার মন্ডার তৈরী পদ্ধতি এখনো সাধারণ মানুষের অজানা। মুল দোকারনে মন্ডার বৈশিষ্ট্য ও স্বাদ অন্য দোকানের মন্ডায় নেই।
মুক্তাগাছা মুলত জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। জমিদার বাড়ির চারদিকে যে পরিখা গড়ে ওঠে, তার পূর্ব পাশে কাটা হয় বিঞ্চুসাগর নামে এক বিশাল দিঘি। এই দিঘির পৃর্ব ও পশ্চিম পাশে দুটি বজরা গড়ে উঠে; এবং তা আস্তে আস্তে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বড় রাস্তার দু’পাশে বসতি গড়ে উঠার ফলে বড়হিস্যার দক্ষিণে-‘বড়হিস্যা বাজার’; দিঘির পৃর্ব পাড়ের বাজারের নাম-‘আটনীবাজার’ এবং পশ্চিম পাড়ে বাজার ‘দরিচারিনী বাজার’ নামে পরিচিত লাভ করে। মহারাজার বাজার অর্থাৎ আটানী বাজারে হাটের সাঙ্গে গরুর হাট ছিল। কিন্তু পাকিস্তান শাসন শুরুর পর সেই গো-হাটে মসজিদ নির্মিত হওয়ার কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম দিকে মুক্তাগাছা জমিদারবাড়িকে কেন্দ্র করে মুগড়ে উঠলেও; ক্রমশ ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা শুরু করে। ১২৯৬ সালে এ স্থানের যথেষ্ট উন্নতি হয়। কিন্ত ১৩০৪ সালের ভূমিকম্পে শহরটি বিশাল ক্ষতি হয়। এই ভূমিকস্পের ফলে মুক্তাগাছার একপ্রান্তে দ্বারালে অন্য প্রান্ত দেখা যেত। দুটি দালান ছাড়া অধিকাংশ দালানই সেই সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এর জনসংখ্যা ও পরিধি ক্রবাড়তেই থাকে। পাকিস্তান হবার পর হিন্দুরা চলে যেতে থাকলে এর বৃদ্ধি বাঁধা প্রাপ্ত হয়। তার পর থেকে এটি মুসলমান প্রাধান্যে হিসাবে গড়ে উঠে। প্রথম দিকে এই স্থানটি হিন্দু প্রধান হওয়ায় হিন্দুদের বিশেষ দিনে শহরটি উৎসবমুখর হয়ে উঠত। রথযাত্রা, ঝুলনযাত্র, জন্মাষ্টমী, দূর্গাপূজা, লীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা, রাসপূজা, সরস্বতী পূজা, দোলযাত্রা, শিবরাত্রী, বাসন্তীপূজা, অষ্টমীস্নান ইত্যাদি উৎযাপিত হতো বিশাল আয়োজনে । জমিদারগণ কতর্ৃক মুক্তাগাছায় প্রতিষ্ঠিত দেবগ্রহের মধ্যে বিলামদেবী প্রতিষ্ঠিত জোড়ামন্দিরে আনন্দময়ী কালী ও শিব উল্লেখযোগ্য।
পৌরসভা শুরুরলগ্নে মহারাজা সূর্যকান্তের নেতৃত্বে একটি পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপিত হয়। লাইব্রেরিটি ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবার পর আরেকটি লাইব্রেরি গড়ে উঠে। বিশাল সংগ্রহের লাইব্রেরীটি রাজকেন্দ্রিক হইলেও সর্বসাধারন অধ্যায়ন করতে পারতো। পাকিস্তান হওয়ার পর পাকিস্তান-সরকার লাইব্রেরিটির দুর্লভ সংগ্রহ পূর্বপাকিস্তানে স্থানান্তর করে নেয়। এখানে থিয়েটার করার প্রচলন ছিল বহুকাল পূর্ব থেকেই। তখন ছোটহিস্যার অমৃতনারায়নের নেতৃত্বে নাট্য-অভিনয় পরিচালিত হত। অ্যামেচা নামে একটি ক্লাব স্থাপিত হয়, যার কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। তাই জমিদারগন তাদের পছন্দ মত- কখনো মিলিত ভাবে, কখন্ও একক ভাবে শখ করে, নিজেদের অর্থ ব্যয় করে অভিনয়াদি করতেন। পূর্ব চৌতরফের জামাতা শ্রীরমে শচন্দ্র সান্যাল মহাশয় এই ক্লাবের নেতৃত্বে ছিলেন। পরে সেতু সেনের তত্ত্বাবধানে নাটমন্দিরের পশ্চিম পাশে একটি স্থায়ী রিভলভিং স্টেজ র্নিমান করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘ভূপেন্দ্র রঙ্গপীঠ’।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের জন্ম শত বার্ষিকী উপলক্ষে তখনকার রাজা ছয় শজ্জা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল র্নিমানের প্রস্তাব দেন। পরে তা সকলের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং নামকরন করা হয় ‘মুক্তাগাছা আর্তাশ্রম’। পাকিস্তান হওয়ার পর জমিদারগণ মুক্তাগাছা ত্যাগের পূর্বে এটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন।
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম
ফোন – ০১৭১৮৭৫১৮২
ইমেইল jalam@machizo.com